পেটে গ্যাস / গ্যাস্ট্রিক
প্রচলিত ভাষায় “পেট ফেঁপে”যায়নি এমন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া কঠিন।পেটে গ্যাসের আক্রমণ কেন হয়, সে সম্পর্কেপরিষ্কার ধারণা থাকলে আপনি সহজেইঅপ্রীতিকর অবস্থা এড়াতে পারেন। আঁশযুক্তখাবার ও শাকসবজি বেশি খেলে পাকস্থলী তারসবটা সহজে পরিপাক করতে পারে না। কিছুখাবার অপরিপাক অবস্থায় চলে যায় ক্ষুদ্রান্ত্রে।সেখানে কিছু ব্যাকটেরিয়া ওসব খাবার খায়।এদের আয়ু খুব কম। মৃত ব্যাকটেরিয়াগুলোথেকে গ্যাস তৈরি হয়। আর অস্বস্তির কারণএটাই।সম্পূর্ণ গম বা আটা দিয়ে তৈরি খাবারগুলোপেটে গ্যাস সৃষ্টি করে। আটা বা ময়দা দিয়েতৈরি বিভিন্ন পিঠা, বিস্কিট ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যপরিত্যাগ করুন।ফল এবং সবজি কাঁচা খাওয়ার পরিবর্তে সেদ্ধ বারান্না করে খান। পেটের গ্যাস এতে কমে যাবেঅনেকটাই।পেটে গ্যাস হলে তরকারিতে সামান্য বেশিপরিমাণে হলুদ দিন। হলুদ পেটের গ্যাস কমাতেখুবই সাহায্য করে।
আমেরিকান রিসার্চ সেন্টার অবগ্যাস্ট্রোএন্টারোলজির মতে, পৃথিবীর মোটজনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশই গ্যাসের সমস্যায়ভুগছে।
মনে রাখতে হবে, খাবার পর অন্ত্রে (ক্ষুদ্রান্ত্র ওবৃহদান্ত্র) গ্যাস তৈরি হওয়া স্বাভাবিক একটিপ্রক্রিয়া। ২৪ ঘণ্টায় অন্তত এক থেকে চার পাইন্টগ্যাস অন্ত্রে তৈরি হয়। এই গ্যাস ২৪ ঘণ্টায়সাধারণত ১৪ বারে ঢেঁকুর হিসেবে বা পায়ুপথেবের হয়। আমরা যেসব খাবার খাই তা হজমহয়। এই হজম হওয়ার প্রক্রিয়াতেই উপজাত বাবাইপ্রোডাক্ট হিসেবে গ্যাস উৎপন্ন হয়। আবারবৃহদন্ত্রে (যেখানে হজম হওয়া খাবার মলহিসেবে জমা থাকে) থাকে অনেক ব্যাকটেরিয়া।এগুলোও গ্যাস তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।যে গ্যাসগুলো অন্ত্রে তৈরি হয় তার মধ্যে আছেকার্বন ডাই-অক্সাইড, হাইড্রোজেন ও মিথেনগ্যাস। কখনো কখনো সালফাইড জাতীয়গ্যাসও তৈরি হয়। কোনো কারণে স্বাভাবিকেরচেয়ে গ্যাস তৈরি হলে গ্যাস সমস্যা তৈরি হয়।গ্যাস তৈরি হওয়ার সমস্যা সাধারণত তিনধরনের।
* বেলচিং বা ঢেঁকুর ওঠা
* ব্লটিং বা পেট ফুলে যাওয়া
* ফাস্টিং বা পায়ুপথে গ্যাস বের হওয়া
বেলচিং বা ঢেঁকুর ওঠা
ঢেঁকুর ওঠা স্বাভাবিক, তবে স্বাভাবিকের চেয়েবেশি ওঠা অস্বস্তিকর ও কষ্টকর। সাধারণতনিচের কারণগুলোর জন্য স্বাভাবিকের চেয়েবেশি ঢেঁকুর ওঠে।
* খাবার গ্রহণের সময় অপ্রয়োজনে বেশি বেশিঢোক গিললে, কথা বেশি বললে, বারবার পানিপান করলে পাকস্থলীতে বাড়তি বাতাসপরিবেশ থেকে প্রবেশ করে। এগুলো পরে বেরহয়।
* ধূমপান, হুঁকো বা পাইপ খেলে।
* কোল্ডড্রিংকস বা সোডা-জাতীয় পানীয় বেশিবেশি পান করলে।
* জুস বা কোনো ড্রিংকস পানের সময় স্ট্রব্যবহার করলে।
* চুইংগাম বা চিবিয়ে খেতে হয় এমন খাবারবেশি খেলে।
* ঠিকমতো ফিট হয়নি এমন নকল দাঁত ব্যবহারকরলে। এ ক্ষেত্রে ঢোক গেলার হার বেশি হয় ওআটকে পড়া বাতাস পাকস্থলীতে ঢুকে যায়।
* অভ্যাসের কারণেও অনেকের বেশি ঢেঁকুরওঠে।
* কিছু অসুখের কারণে বেশি বেশি ঢেঁকুর উঠতেপারে। যেমন_
জিইআরডি বা গ্যাস্ট্রো ইসোফেজাল রিফ্লাক্সডিজিজ (বুকজ্বলা), হায়াটাস হার্নিয়া, ফ্রুক্টোজম্যাল অ্যাবজর্বশন বা চিনি-জাতীয় খাদ্যশোষণজনিত সমস্যা, ইউরেমিয়া, ক্রনিকরেনাল ফেইলিওর ও ডায়াফ্রামের ইরিটেশন।
ব্লটিং বা পেট ফুলে যাওয়া
এই রোগে পেট ফুলে যায়, বুকে অস্বস্তি বোধ হয়,সব সময় পেট ভরা ভরা অনুভূত হয়, অনেকসময় বুকে চাপ ধরা ব্যথার মতো মনে হয়।কোনো কোনো সময় বুকের ব্যথা বা অস্বস্তিকেরোগী ও চিকিৎসক উভয়ই হার্টের অসুখ বাএনজাইনা বলে বিভ্রান্ত হন, আতঙ্কিত হয়েপড়েন।
নিচের কারণগুলোর জন্য ব্লটিং হয়_
- কিছু খাবারের কারণে, যেমন_শিমের বীজ, মটরশুঁটি, ডালজাতীয় খাবার,চর্বিজাতীয় বা তৈলাক্ত খাবার, দুধ ও দুগ্ধজাতখাবার_ঘি, পনির, দই ইত্যাদি।কিছু সবজি যেমন_ওল, আলু, পেঁয়াজ ইত্যাদি।কিছু ফল যেমন_আপেল, কলা ইত্যাদি।সিরিয়াল (যেমন কর্নফ্লেক্স), কেক, পেস্ট্রি,চকোলেট, কোল্ডড্রিংকস ইত্যাদি।
- কিছু কিছু অসুখের কারণে, যেমন_জিইআরডি বা গ্যাস্ট্রো ইসোফেজিয়ার রিফ্লাক্সডিজিজ (বুকজ্বলা)পিইউডি বা পেপটিক আলসার ডিজিজ।পিত্তথলির পাথর বা গলস্টোন।আইবিএস বা ইরিটেবল বাওল সিনড্রোম।
কী করণীয়
এ ধরনের সমস্যায় পড়লে ডাক্তার দেখাতে হবে।তিনি পরীক্ষা করে যদি বলেন, আপনার পেটেরঅস্বস্তি কোনো অসুখের কারণে নয়, সে ক্ষেত্রেআপনি কয়েকটি নিয়ম মেনে চললে ভালোথাকবেন।
১. পরীক্ষা করে নিজেই নিশ্চিত হোন কোনখাবারের কারণে আপনার সমস্যা হচ্ছে। এটিদুটি পদ্ধতিতে নিশ্চিত করা যায়_
- আপনার যদি মনে হয় বিশেষ ধরনের খাবারের জন্য সমস্যা হচ্ছে, তার একটিতালিকা তৈরি করুন। ধরা যাক, আপনার দুধ ওদুগ্ধজাত খাবারে সমস্যা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রেযেকোনো এক ধরনের (ধরুন দুধ ও দুগ্ধজাতখাবার) খাবার অন্তত সাত দিন বন্ধ রাখুন। যদিদেখেন এতে আপনার সমস্যা কমে গেছে,তাহলে বুঝবেন এটিই আপনার অস্বস্তির কারণ।কিন্তু যদি আপনার সমস্যা একই রকম থাকে,তবে এটি খাওয়া আবার শুরু করে তালিকারঅন্য ধরনের খাবার অন্তত সাত দিন বন্ধ রাখতেহবে। এ প্রক্রিয়ায় নিশ্চিত হোন নির্দিষ্ট কোনোখাবারে আপনার সমস্যা হচ্ছে কি না।
- দ্বিতীয় পদ্ধতি হলো সন্দেহজনক সব খাবারসাত দিন বন্ধ রাখা। এরপর প্রতিদিন ওই সন্দেহ ভাজন খাদ্য এক এক করে যোগ করুনএবং লক্ষ করুন তাতে সমস্যা হচ্ছে কি না।যেমন_সবজি যোগ করুন এবং খেয়াল করুনকোনো সমস্যা হচ্ছে কি না। সমস্যা হলে তোবুঝেই গেলেন, না হলে এর সঙ্গে আবার অন্যখাবার যোগ করুন। এভাবে বন্ধ করে দেওয়াখাবারগুলো আবার এক এক করে যোগ করেদেখুন নির্দিষ্ট কোন খাবারে সমস্যা হচ্ছে।
২ . অনিয়ম ও টেনশন করলে পেটে গ্যাস হওয়া বেড়ে যায়।তাই কিছু নিয়ম মেনে চলুন_
* চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করুন।
* ধূমপান করবেন না।
* দুগ্ধজাত খাবার কম খাবেন।
* খুব দ্রুত খাবার খাবেন না। খাবার ধীরে ধীরেসময় নিয়ে ও অল্প অল্প করে খান।
* খাবারের মাঝখানে কখনো পানি খাবেন না।এমনকি খাবারের পর এক থেকে দুুুই ঘণ্টারমধ্যেও পানি না খাওয়াই ভালো। কারণ এতেডাইজেসটিভ জুস পাতলা হয়ে যায়, খাবারহজম হতে দেরি হয় বা বদহজম হয়।
* হাঁটা অবস্থায় অথবা কোনো কাজ করা অবস্থায় খাবেন না। এমনকি টিভি দেখতে দেখতেও খাবেন না। শান্তভাবে বসে খাবার খান।
* খাবার দুই ঘণ্টার মধ্যে ঘুমাতে যাবেন না।
* কখনো একবারে খুব বেশি খাবেন না। পেটযেন অল্প একটু খালি থাকে, সেটা খেয়াল রাখুন।
* অল্প অল্প করে বারবার খান।
* আদা চা, লবণ ইত্যাদি খান। এতে গ্যাস তৈরি হওয়া কমে যায়। রাত জাগবেন না।
* কখনো হঠাৎ বুকে ব্যথা হলে, চাপ চাপ ব্যথাহলে অবহেলা করবেন না। হার্টের ব্যথা কি নাতা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হোন।
ফাস্টিং বা পায়ুপথে গ্যাস বের হওয়া
এটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া কিন্তু কখনো বেশি হলেঅস্বস্তি ও বিরক্তির কারণ হয়ে থাকে। এটিসাধারণত কোনো অসুখের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়।
* গ্যাসের সমস্যার সঙ্গে আলসার না থাকলেকখনোই রেনিটিডিন বা ওমিপ্রাজল খাওয়ারপ্রয়োজন নেই। বরং সিমেথিওন বা মোটিলিটিস্টিমুল্যান্ট-জাতীয় ওষুধ দিন।
এসিডিটি বা বুকজ্বলা
পাকস্থলীতে খাদ্য হজমের জন্য সহায়কহাউড্রোক্লোরিক এসিড তৈরি হয়। এই এসিডযাতে পাকস্থলীর ভেতরের গাত্রকে হজম বা ক্ষয়(আলসার) করে না ফেলে সে জন্য পাকস্থলীরভেতরের দিকে একটি পিচ্ছিল আবরণ থাকে। এআবরণটিতে থাকে মিউকাস লেয়ার বামিউকাসের আস্তর। কোনো কারণে এসিডনিঃসরণ বেড়ে গেলে বা পাকস্থলী রক্ষাকারীগাত্রটি ক্ষয়প্রাপ্ত (আলসার) হলে পেটেরউপরিভাগ জ্বলে। পাকস্থলী ওপরের দিকেইসোফেগাসের (খাদ্যনালীর অংশ) সঙ্গে যুক্তথাকে। কোনো কারণে এই এসিড যদিইসোভেগাসে আসে, তবে বুকজ্বলা সমস্যাটিদেখা দেয়। বুকজ্বলা সমস্যাটি হার্টবার্ন নামেওপরিচিত। বাংলাদেশে এসিডিটিতে আক্রান্ত ৯০শতাংশ লোকেরই পাকস্থলীর মিউকাস স্তরক্ষয়ের বড় কারণ হেলিকোব্যাকটার পাইলোরিনামের ব্যাকটেরিয়া। সাধারণত খালি পেটেইএই জ্বলাভাব বেশি হয়। এর সঙ্গে মুখ টক টকহয়, কখনো কখনো বমি-বমি ভাবও হয়।
যাদের আলসার আছে তাদের রক্তবমি, কালোরঙের পায়খানা হতে পারে। এ ছাড়া অতিরিক্তরক্তক্ষরণে রোগী শক বা অজ্ঞান হয়ে যেতেপারে।
গ্যাস এড়াতে
১) ডাল ও ডাল জাতীয় খাবার ডাল, বুট, ছোলা, বীণ, সয়াবিন ইত্যাদি ধরণেরখাবার গ্যাস উদ্রেকককারী খাবার। এগুলোতেরয়েছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, সুগার ওফাইবার যা সহজে হজম হতে চায় না। ফলেগ্যাসের সমস্যা সৃষ্টি করে পেটে।
২) ব্রকলি, পাতাকপি, বাঁধাকপি
এইধরনের সবজিগুলোতে রয়েছে ‘রাফিনোজ’নামক একধরণের সুগার উপাদান যা পাকস্থলীরব্যাকটেরিয়া ফারমেন্ট না করা পর্যন্ত হজম হয়না। এবং এই অবস্থায় পেটে গ্যাসের সমস্যা বৃদ্ধিপায়।
৩) দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার
দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার পর যদি দেখেন পেটেগ্যাস হচ্ছে তার অর্থ হচ্ছে আপনি লাক্টোজইন্টলারেন্ট অর্থাৎ আপনার দুধ ও দুগ্ধজাতখাবার হজমে সমস্যা রয়েছে। হজম হয় নাবলেই এগুলো আপনার পেটে গ্যাস উদ্রেকেরজন্য দায়ী।
৪) আপেল ও পেয়ারা
আপেল ও পেয়ারাতে রয়েছে ফাইবার এবংফ্রক্টোজ ও সরবিটোল নামক সুগার উপাদান যাসহজে হজম হতে চায় না। এতে করেও গ্যাস হয়পেটে।
৫) লবণাক্ত খাবার
লবণের সোডিয়াম অনেক বেশি পানিগ্রাহী।অতিরিক্ত লবণাক্ত খাবার খেলে দেহে পানিজমার সমস্যা দেখা দেয়। পাকস্থলীতেও সমস্যাশুরু হয় ও খাবার হজম হতে চায় না।
এছাড়াও ধীরে ধীরে ও ভাল করে চিবিয়ে খাবারখান , চুইংগাম ও শক্ত ক্যান্ডি পরিহার করুন,কার্বনেটেড কোমল পানীয় ও বিয়ার এড়িয়েচলুন। এগুলো কার্বন ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে।
শসা পেট ঠা-া রাখতে অনেক বেশি কার্যকরীখাদ্য। এতে রয়েছে ফ্লেভানয়েড ও অ্যান্টিইনফ্লেমেটরি উপাদান যা পেটে গ্যাসের উদ্রেককমায়।
২) দই
দই আমাদের হজম শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তাকরে। এতে করে দ্রুত খাবার হজম হয়, ফলেপেটে গ্যাস হওয়ার ঝামেলা দূর হয়।
৩) পেঁপে
পেঁপেতে রয়েছে পাপায়া নামক এনজাইম যাহজমশক্তি বাড়ায়। নিয়মিত পেঁপে খাওয়ারঅভ্যাস করলেও গ্যাসের সমস্যা কমে।
৪) কলা ও কমলা
কলা ও কমলা পাকস্থলীর অতিরিক্ত সোডিয়ামদূর করতে সহায়তা করে। এতে করে গ্যাসেরসমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এছাড়াও কলারস্যলুবল ফাইবারের কারণে কলা কোষ্ঠকাঠিন্যদূর করার ক্ষমতা রাখে।
৫) আদা
আদা সবচাইতে কার্যকরী অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরিউপাদান সমৃদ্ধ খাবার। পেট ফাঁপা এবং পেটেগ্যাস হলে আদা কুচি করে লবণ দিয়ে কাঁচা খান,দেখবেন গ্যাসের সমস্যা সমাধান হবে।
খাবার খাওয়ার সময় মাঝে মাঝে অল্প অল্প করে পানি পান করুন, কিন্তু খাবার শেষে একটু দেরিকরে (১ ঘণ্টা পরে) পানি পান করুন। এবংকোনো ওষুধ খাওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শগ্রহণ করুণ।
অতিরিক্ত তেলেভাজা ও তেল জাতীয় খাবার,সফট ড্রিংকস, ঝাল খাবার, খাবার ভালোভাবেচিবিয়ে না খাওয়া, হজমে সমস্যা এমনকিঅতিরিক্ত দুশ্চিন্তার জন্যও পেটে গ্যাস জমতেপারে।