ফুলকপি | Cauliflower


ফুলকপি

ফুলকপি একটি পুষ্টিকর, সুস্বাদু ও আমাদের দেশে জনপ্রিয় সবজি। পশ্চিমবঙ্গে ১৯৯৬-৯৭ সালে মোট ১০ হাজার হেক্টর জমিতে ফুলকপি চাষাবাদ হয় এবং উৎপাদন হয় প্রায় ৭৬ হাজার টন। আমাদের দেশে চাষকৃত ফুলকপি অধিকাংশই সংকর জাতের এবং বিদেশ থেকে আমদানিকৃত যা স্থানীয় আবহাওয়ায় বীজ উৎপাদন করে না। ঠাণ্ডা ও আর্দ্রতা জলবায়ুতে ফুলকপির ভাল ফলন পাওয়া যায়। সেচ ও পানি নিষ্কাশনের সুবিধা আছে এমন ধরনের সব মাটিতে ফুলকপির চাষ ভাল হয়। আমাদের দেশে মাঘী, অগ্রহায়ণী, পৌষালী, বারি ফুলকপি-১, ২ ইত্যাদি বিভিন্ন জাতের ফুলকপি পাওয়া যায়।
ফুলকপি বপনের উপযুক্ত সময় হল আগষ্ট ও সেপ্টেম্বর। প্রতি শতকে বীজের পরিমাণ দুই গ্রাম। বীজতলার জন্য ৩ ×১ মিটার মাপের ১৫ সে.মি. উঁচু বেড তৈরি করলে ভাল হয়। বীজতলার উপরের স্তরে ১:১ অনুপাতে পচা গোবর/আবর্জনা সার এবং দো-আঁশ মাটির মিশ্রণ ছড়িয়ে দিতে হবে। এরপর তিন-চার সপ্তাহ পলিথিন দিয়ে মাটি ঢেকে রেখে শোধনের পর পাঁচ সে. মি. দূরে দূরে লাইনে ছিটিয়ে ১০ গ্রাম বীজ বুনতে হবে। অতিবৃষ্টি ও রোদের ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য উপরে পলিথিন বা চাটাইয়ের আচ্ছাদন দিতে হবে। ১০ দিন পর দ্বিতীয় বীজতলায় পাঁচ সে.মি. পর পর সারি করে দুই সে.মি. দূরে দূরে শেষ বিকেলে স্থানানস্তর করতে হবে। দ্বিতীয় বীজতলায় চারা স্থানানস্তরের পাঁচ দিন পর বীজতলার চারায় প্রতি ১০ লিটার পানির সাথে ৩০ গ্রাম সোহাগা মিশিয়ে স্প্রে করা অত্যাবশ্যক।
জাত
এ দেশে এখন ফুলকপির পঞ্চাশটিরও বেশি জাত পাওয়া যাচ্ছে। শীতকালেই আগাম, মধ্যম ও নাবি মওসুমে বিভিন্ন জাতের ফুলকপি আবাদ করা যায়। আগাম চাষ করা যায় ফুলকপির এমন জাতগুলো হলো অগ্রহায়ণী, আর্লি পাটনা, আর্লি স্নোবল, সুপার স্নোবল, ট্রপিক্যাল স্নো ৫৫, সামার ডায়মন্ড এফ১, ম্যাজিক স্নো ৫০ দিন এফ১, হোয়াইট বিউটি, কেএস ৬০, আর্লি বোনাস, হিট মাস্টার, ক্যামেলিয়া, আর্লি মার্কেট এফ১, স্পেশাল ৪৫ এফ১, স্নো কুইন এফ১ ইত্যাদি। এসব জাতের বীজ শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে বপন করা যায়। মাঝ মওসুমের উপযুক্ত অনেক জাত আছে। এগুলো হলো বারি ফুলকপি ১ (রূপা), চম্পাবতী ৬০ দিন, চন্দ্রমুখী, পৌষালী, রাুসী, স্নোবল এক্স, স্নোবল ওয়াই, হোয়াইট টপ, স্নো ওয়েভ, মোনালিসা এফ১, ম্যাজিক ৭০ এফ১, বিগটপ, চন্দ্রিমা ৬০ এফ১, হোয়াইট ফ্যাশ, বিগশট, হোয়াইট কনটেসা ইত্যাদি। এসব জাতের বীজ ভাদ্র-আশ্বিন মাসে বপন করতে হয়। নাবি করে ফুলকপি চাষ করতে চাইলে মাঘী বেনারসি, ইউনিক স্নোবল, হোয়াইট মাউন্টেন, এরফার্ট ইত্যাদি জাত লাগানো যেতে পারে। এসব জাতের বীজ আশ্বিন-কার্তিক মাসে বপন করতে হয়।


1..ফুলকপিতে রয়েছে ভিটামিন ‘বি’, ‘সি’, ‘কে’, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম ও জিংক।

2..একটি মাঝারি আকারের ফুলকপিতে রয়েছে শক্তি-২৫ কিলোক্যালরি, কার্বোহাইড্রেট-৪.৯৭ গ্রাম , প্রোটিন-১.৯২ গ্রাম , ফ্যাট-০.২৮ , আঁশ-২ গ্রাম, ফোলেট-০.৫৭ মাইক্রোগ্রাম, নিয়াসিন-০.৫০ মাইক্রোগ্রাম, থায়ামিন-০.০৫ , প্যানথানিক এসিড-০.৬৬৭ মাইকোগ্রাম।

3.. ফুলকপি পুষ্টিসমৃদ্ধ সবজি।এর পাতার উপরিভাগে ক্যানসার নিরোধক উপাদান পেয়েছেন বলে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। বাল্টিমোর জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনের গবেষকরা ফুলকপির পাতায় আইসো থায়োসায়ানেটস নামক রাসায়নিক পদার্থ পেয়েছেন। বিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখেছেন, মলাশয় ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অর্ধেক কমাতে হলে সপ্তাহে প্রায় দুই পাউন্ড ফুলকপি এবং এ জাতীয় শাকসবজি খেতে হবে। বিজ্ঞানীরা আরও জানিয়েছেন, ফুলকপির কচি পাতা সপ্তাহে এক আউন্সের কিছু বেশি খেলে তার দেহে ক্যানসারের ঝুঁকি অর্ধেক কমতে পারে। আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, ফুলকপির কচি পাতা থেকে সংগৃহীত আইসো থায়োসায়ানেটস নির্যাস প্রয়োগে ওদের বুকের টিউমারের আকার ও সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে, যা ক্যানসারে রূপ নেওয়ার আশঙ্কা ছিল।ফুলকপির পাতায় প্রচুর ভিটামিন ‘এ’ ক্যালসিয়াম, খাদ্যশক্তি ও আয়রন আছে। এতে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কালো কচুশাকের চেয়ে প্রায় দেড়গুণ, সবুজ কচুশাকের চেয়ে প্রায় ৩ গুণ, লালশাকের চেয়ে দ্বিগুণ, কলমিশাকের চেয়ে ৬ গুণ, পুঁই ও পাটশাকের চেয়ে ৭ গুণ, পালং ও ডাঁটা শাকের চেয়ে ৮ গুণ, মুলাশাকের চেয়ে ২৫ গুণ ও গরুর দুধের চেয়ে ৫ গুণ বেশি আছে। ফুলকপির কচি পাতায় প্রায় সব খাদ্যের চেয়ে অনেক বেশি আয়রন আছে। যেমন-সবুজ কচুশাকের চেয়ে ৪ গুণ, ডাঁটা শাকের চেয়ে দেড় গুণ, কলমিশাকের চেয়ে ১০ গুণ, মুলাশাকের চেয়ে ১২ গুণ ও পালংশাকের ৫ গুণ বেশি আয়রন আছে। খাদ্যশক্তিও প্রায় সব শাকসবজির চেয়ে অনেক বেশি আছে। প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’ আছে। খাদ্যোপযোগী প্রতি ১০০ গ্রাম ফুলকপির পাতায় ক্যালসিয়াম ৬২৬ মিলিগ্রাম ও আয়রন ৪০ মিলিগ্রাম থাকে। ফুলকপিতে আয়রনের পরিমাণ আলু, মুলা, মিষ্টিকুমড়া, বেগুন, টমেটো, চিচিঙ্গা ও ঝিঙ্গার চেয়ে বেশি। তবে এই পুষ্টিমান ফুলকপির জাত ও উত্পাদনের স্থানের ওপর নির্ভরশীল।

 


ক্যান্সার প্রতিরোধ
ফুলকপিতে সালফারের যৌগ সালফোরাফেন থাকে যা ব্লাড প্রেশারের উন্নতিতে সাহায্য করে। ফুলকপিতে থাকা সালফোরাফেন ক্যান্সার সৃষ্টিকারী কোষ ধ্বংস করতে পারে এবং টিউমারের বৃদ্ধিকে বাঁধা দেয়। ফুলকপির সাথে হলুদ যোগ করে গ্রহণ করলে প্রোস্টেট ক্যান্সার নিরাময়ে ও প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা রাখে। এছাড়া পাকস্হলী, প্রোষ্টেট, স্তন ও ডিম্বাশয় ক্যান্সার প্রতিরোধেও সাহায্য করে ফুলকপি।

মস্তিষ্কের উন্নতি ঘটায়
ফুলকপি মস্তিষ্ক ভালো রাখে, ফুলকপিতে ভিটামিন বি রয়েছে যা মস্তিষ্কের উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। গর্ভাবস্থায় এ সবজি একটি ভালো খাদ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। ফুলকপি নবজাতকের মস্তিষ্কের উন্নতি সাধন করতে কাজ করে।

ফুসফুসকে রক্ষা করে
ফুলকপি ফুসফুস রক্ষায় সহায়তা করে।শেফ জাহেদ এর মতে 2020 নতুন এক গবেষণায় জানা গেছে, ভয়াবহ ফুসফুস রোগের জন্য যেসব কারণ দায়ী তা প্রতিরোধে ফুলকপি সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। ডায়াবেটিসের কারণে রক্তনালীর যে ক্ষতি হয় সবজিটি তা প্রতিরোধেও সহায়তা করে। এছাড়া ফুলকপি হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমিয়ে দেয়।

শরীরকে বিষমুক্ত হতে সাহায্য করে
ফুলকপির অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান শরীর পরিষ্কার হতে সাহায্য করে। এছাড়াও এতে গ্লুকোসাইনোলেটস থাকে যা এনজাইমকে সক্রিয় করে এবং ডিটক্স হতে সাহায্য করে।

প্রদাহ কমায়
ফুলকপিতে ইন্ডোল ৩ কার্বিনোল বা I3C থাকে যা একটি অ্যান্টিইনফ্লামেটরি উপাদান। এটি শক্তিশালী ইনফ্লামেটরি রিঅ্যাকশন প্রতিরোধ করে।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে
শীতের সুস্বাদু সবজি ফুলকপির আরও একটি অন্যতম গুণের একটি হল রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা। যারা ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপজনিত সমস্যায় ভুগে থাকেন, তারা ফুলকপি খাবারের তালিকায় রাখতে দ্বিধা করবেন না।
চোখকে ভালো রাখে
ফুলকপিতে ভিটামিন এ-এর পরিমাণ বেশি থাকায় চোখকে সুস্থ রাখতে সহায়তা করে। এমনকি দেহের কোথাও কেটে গেলে ফুলকপির কচি পাতার রস লাগালে ভালো ফল পাওয়া যায়।
হজমের উন্নতি ঘটায়
ফুলকপি হজমে সাহায্য করে, ফাইবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হওয়ায় ফুলকপি হজমে সাহায্য করে। সবজিতে বিদ্যমান ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সুস্থ থাকতেও ভূমিকা রাখে।
বাড়তি ওজন কমাতে
ফুলকপি শরীরের বাড়তি মেদ কমিয়ে শরীরকে একটি সুন্দর গঠনে আনতে সাহায্য করে। যারা তাদের শরীরের বাড়তি ওজন নিয়ে চিন্তিত ও ডায়েট করার কথা ভাবছেন তারা নির্দ্বিধায় ডায়েট লিস্টে ফুলকপির নাম অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন।
ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে সমৃদ্ধ
ফুলকপিতে ভিটামিন সি, বিটাক্যারোটিন, কায়েম্ফেরোল, কোয়ারসেটিন, রুটিন, সিনামিক এসিড সহ আরো অনেক উপাদান থাকে। এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলো ফ্রি র্যাডিকেলের ক্ষতির হাত থেকে শরীরকে সুরক্ষা দেয়। এগুলো বয়স বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে ধীর গতির করে এবং টিস্যু ও অঙ্গের ক্ষতি হওয়া প্রতিহত করে।
চুলকানি প্রতিরোধ করে
ফুলকপি চুলকানি প্রতিরোধ করে, শীতকালে ঠাণ্ডায় ত্বকে লালচে হয়ে ফুলে যাওয়া এবং চুলকানি হতে পারে। সেক্ষেত্রে ফুলকপির কচি পাতা বেটে লাগালে চুলকানি ভালো হয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

dnt share any link

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম