প্রাচীন মায়া সভ্যতার যুগেও ছিল চকলেটের অস্ত্বিত্ব। এমনকি তারও আগে, দক্ষিণ-পূর্ব মেক্সিকোর প্রাচীন ওলমেক সভ্যতায়ও এর প্রচলন খুঁজে পেয়েছেন ইতিহাসবিদরা। 'চকলেট' শব্দটা শুনলেই মিষ্টি ক্যান্ডি বার ও মনোরম মিষ্টান্নের ছবি চোখে ভেসে ওঠে; তবে সুদূর অতীতের চকলেটের সঙ্গে আজকের দিনের চকলেটের মিল খুবই কম। ইতিহাস জানান দেয়, অতীতে চকলেট কোনো মিষ্টি ও ভক্ষণযোগ্য নয়, বরং ছিল তিতা স্বাদের খুবই সম্মানজনক পানীয়!
কোকো গাছের ফল থেকে তৈরি হয় চকলেট। সেন্ট্রাল ও দক্ষিণ আমেরিকায় পাওয়া যায় এ গাছ। গুটি গুটি ফলগুলোর একেকটিতে ৪০টির মতো বিন বা শুটি থাকে। শুটিগুলো শুকিয়ে, তারপর পুড়িয়ে বানানো হয় কোকো বিন।কে কখন কীভাবে প্রথম এই উপায় আবিষ্কার করেছিলেন, জানা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথসোনিয়ার ন্যাশনাল মিউজিয়ামের কালচারাল আর্ট কিউরেটর হায়েস লেভিস জানান, খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ থেকেই প্রাচীন ওলমেক সভ্যতার মানুষেরা নৌযান ভরে কোকো ফল নিয়ে আসতেন।
ধারণা করা হয়, ওলমেকরা কোকো দিয়ে তাদের উৎসব-আয়োজনের বিশেষ পানীয় বানান। অবশ্য ইতিহাসে যেহেতু এ কথা স্পষ্টভাবে লেখা নেই, ফলে এ সম্পর্কে দ্বিমত রয়েছে। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ মনে করেন, ওলমেকরা স্রেফ তরল পদার্থ হিসেবেই কোকো বিনগুলো ব্যবহার করতেন কিংবা গুটিগুলো সাজিয়ে রাখতেন।
ওলমেকরাই যে কোকো সম্পর্কে নিজেদের জ্ঞান সেন্ট্রাল আমেরিকান মায়া সভ্যতায় ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, এ ব্যাপারে ইতিহাসবিদদের সন্দেহ নেই। মায়া সভ্যতার লোকেরা চকলেট শুধু পানই করতেন না, একে খুব সমীহও করতেন।
মায়ার লিখিত ইতিহাসে উল্লেখ আছে, বিশেষ বিশেষ লেনদেন চূড়ান্ত করার অনুষ্ঠানে চকলেট পানীয় পরিবেশন করা হতো।
যদিও মায়া সংস্কৃতিতে চকলেটের গুরুত্ব ছিল, তবে এটি শুধু সম্পদশালী ও ক্ষমতাধরদের জন্য সংরক্ষণ করা হতো না, বরং প্রায় সবাই স্বাদ নিতে পারার মতোই সহজলভ্য ছিল। অনেক মায়া পরিবারই প্রতি বেলার আহারে চকলেটের স্বাদ নিতেন। মায়া সভ্যতার সময়কালের চকলেট ছিল ঘন ও ফেনাময়; এমনকি তার সঙ্গে লাল মরিচ, মধু কিংবা পানি মেশানো হতো।
১৪২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত আজটেক সভ্যতার লোকেরা চকলেটকে আরেকটি স্তরে নিয়ে গেছেন। তারা বিশ্বাস করতেন, এটি স্বয়ং ঐশ্বরিক উপহার। মায়াদের মতোই তারাও সুসজ্জিত পাত্রে গরম ও ঠাণ্ডা ক্যাফেইন, স্পাইসড চকলেট পানীয় পান করতেন; তবে খাবার ও অন্যান্য পণ্য কিনতে তারা মুদ্রা হিসেবেও কোকো বিন ব্যবহার করতেন। আজটেক সংস্কৃতিতে কোকো বিনকে স্বর্ণের চেয়ে দামি হিসেবে গণ্য করা হতো।
ইউরোপে যখন প্রথম চকলেট এলো, তখন এটি এতই দামি ও বিলাসী জিনিস ছিল, শুধু বড়লোকেরাই এর স্বাদ নিতে পারতেন। তবে ১৮২৮ সালে ডাচ রসায়নবিদ কোয়েনরাড জোহানেস ভ্যান হাউটেন লবণের ক্ষারের সঙ্গে কোকো বিন মিশিয়ে এক ধরনের পাউডার চকলেট উদ্ভাবন করেন, যেটি খুব সহজেই পানিতে মিশিয়ে পান করা যেত।
প্রক্রিয়াটি 'ডাচ প্রসেসিং' নামে খ্যাতি পায়; অন্যদিকে, এভাবে বানানো চকলেটকে ডাকা হয় কোকো পাউডার বা 'ডাচ কোকো'।
ধারণা করা হয়, কোকো প্রেসেরও উদ্ভাবন করেছিলেন ভ্যান হাউটেন; যদিও কেউ কেউ মনে করেন সেই যন্ত্রের উদ্ভাবক আসলে ভ্যানের বাবা। কোকো প্রেসের মাধ্যমে রোস্টেড কোকো বিনগুলো থেকে কোকো বাটার আলাদা করা হতো। ফলে কোকো পাউডার বানানো সহজ হয়ে ওঠে। এভাবে নানা স্বাদের, নানা ধরনের চকলেট তৈরি হতে থাকে।
ডাচ প্রসেসিং ও চকলেট প্রেস— দুটোই চকলেটকে সব শ্রেণির মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসে। চকলেটের বহুল উৎপাদনকেও ত্বরাণ্বিত করে এগুলো।
উনবিংশ শতকের বেশির ভাগ সময় পর্যন্ত চকলেটকে পানীয় হিসেবেই উপভোগ করা হতো; কখনো কখনো তাতে পানির বদলে মেশানো হতো দুধ। ১৮৪৭ সালে ব্রিটিশ চকলেট কোম্পানি জে. এস. ফ্রাই অ্যান্ড সনস প্রথমবার চিনি, তরল চকলেট ও কোকো বাটার মিশিয়ে চকলেট বার উৎপাদন করে।
১৮৭৬ সালে সুইস চকলেট ব্যবসায়ী ড্যানিয়েল পিটার প্রথম চকলেটের সঙ্গে দুধের গুড়ো মিশিয়ে মিল্ক চকলেট উৎপাদন করেন। এর কয়েক বছর পরই বন্ধু হেনরি নেসলের সঙ্গে তিনি নেসলে কোম্পানি গড়ে তোলেন এবং মিল্ক চকলেটকে বড় পরিসরে বাজারে ছড়িয়ে দেন।
উনবিংশ শতক ধরেই বাজারে চকলেট বেশ দাপট দেখালেও তখন কার সময় এটা ছিল অনেক শক্ত, এবং চুষে খাওয়ার অনুপযুক্ত। ১৮৭৯ সালে, আরেক সুইস চকলেট ব্যবসায়ী যার নাম রুডলফ লিন্ড এমন এক মেশিন উদ্ভাবন করেন, যা এমন ভাবে মিশ্রণ ঘটাতে সক্ষম হতো , যার ফলে চকলেট হয়ে ওঠে মসৃণ ও খুবই কোমল।
উনবিংশ শতকের শেষভাগ ও বিংশ শতকের প্রথমভাগে ক্যাডবুরি, মার্স, নেসলে ও হার্সলের মতো কোম্পানিগুলো বিপুল পরিমাণ মিষ্টি চকলেট উৎপাদন ও বাজারজাত করতে থাকে।
আধুনিক সময়ের চকলেট খুবই মসৃণ ও সুস্বাদু। অবশ্য কিছু কোম্পানি এখনো ঐতিহ্য ধরে রেখে শক্ত চকলেটও উৎপাদন করছে। এখন একদিকে যেমন পানীয় চকলেট পাওয়া যায়, তেমনি রয়েছে বিভিন্ন ধরন ও স্বাদের ভক্ষণযোগ্য চকলেটও। এর মধ্যে শেষোক্ত ধরনের চকলেটের চাহিদাই বেশি।
অবশ্য খাদ্য বিশেষজ্ঞদের মতে চকলেট বার খুব একটা স্বাস্থ্যকর নয়; তাই দিন দিন সেটির জায়গা দখল করে নিচ্ছে ডার্ক চকলেট। এটি হৃদপিণ্ডের জন্য ভালো এবং উদ্বেগ কাটাতেও সাহায্য করে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
চকলেটের উপকারিতা ও অপকারিতা কী কী?
x
চিকিৎসকদের মতে, বাজারে মূলত ২ ধরনের চকলেট বেশি পাওয়া যায়। ডার্ক চকলেট এবং মিল্ক চকলেট। ডার্ক চকলেট স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী। চকলেটের মূল উপাদান হলো কোকোয়া যা খাদ্যগুণে ভরপুর। কিন্তু এগুলো একই প্রক্রিয়ায় বানানো হয় না।
মিল্ক চকলেটের তুলনায় ডার্ক চকলেটে কোকোয়ার পরিমাণ থাকে ৭০ ভাগ বেশি। মিল্ক চকলেট বানানো হয় দুধ এবং চিনি দিয়ে। যা দাঁতের ক্ষতি করে এবং রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বৃদ্ধি করে। কিন্তু ডার্ক চকলেটে কোকোয়ার পরিমাণ যতো বেশি থাকবে সেটি স্বাস্থ্যের জন্য বেশি উপকারী হবে।
চলুন জেনে নেই ডার্ক চকলেট আমাদের কি কি উপকারে আসে —
• হার্ট ভালো রাখে: যারা নিয়মিত পরিমাণে ডার্ক চকলেট খায় তাদের হার্টের রোগ হওয়ার ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় কম থাকে। ডার্ক চকলেটের রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক রাখে এবং হার্ট সুস্থ রাখে।
• স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়: এটি উচ্চ রক্তচাপ স্বাভাবিক করে এবং হৃদ্যন্ত্রের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমায়। এ ছাড়া চকলেট রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে এবং মানসিক চাপ কমায়।স্ট্রোকের ঝুঁকি ২০ শতাংশ কমিয়ে আনে ডার্ক চকলেট ।
• ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে: কোকোয়া আমাদের রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ অনেক কমিয়ে আনে ও সাথে ইনসুলিন লেভেল নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে ।
• ত্বক সুন্দর রাখে: এটা আমাদের ত্বক কে রোদ এর তাপ থেকে রক্ষা করে ফলে কাল ভাব তা কম দেখায় .
• মেধা শক্তি বৃদ্ধি করে: স্মৃতি শক্তি ধরে রাখার জন্য ডার্ক চকলেটের তুলনা হয় না। যারা নিয়মিত ডার্ক চকলেট খায় তারা অন্যদের তুলনায় বেশি মেধাবী ও বুদ্ধি সম্পন্ন হয়।
• কোলেস্টেরল কমায়: আমাদের শরীরে ২ ধরনের কোলেস্টেরল থাকে। ভালো কোলেস্টেরল এবং খারাপ কোলেস্টেরল। ডার্ক চকলেটের তেতো স্বাদ আমাদের শরীর থেকে খারাপ কোলেস্টেরল দূর করে ভালো কোলেস্টেরলের পরিমাণ বাড়ায়।
• প্রসূতি মা ও সন্তানের উপকারে আসে: চকলেট প্রসূতি মায়েদের গর্ভকালীন সময়ে মানসিক চাপ দূর করে ।
• ওজন কমায়: অন্যদের তুলনায় যারা চকলেট খায় তারা সুস্বাস্থ্যের ও সুঠাম অধিকারী হয়।
চকলেটের অপকারিতা :
চকোলেট খাওয়ার অসুবিধাগুলির মধ্যে এটি কেবল মোট ফ্যাটই বেশি নয়, তবে স্যাচুরেটেড ফ্যাটও বেশি। চকোলেটের প্রতি 1.55 আউন্স পরিবেশনায় 8.14 গ্রাম স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে, এক ধরণের ফ্যাট যা আপনার হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।
স্যাচুরেটেড ফ্যাট আপনার "খারাপ" এলডিএল কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে তুলতে পারে। আপনার হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন দৈনিক সীমা 16 গ্রাম বা তার চেয়ে কম স্যাচুরেটেড ফ্যাট প্রস্তাব করে। চকোলেট প্রতিটি 1.55-আউন্স পরিবেশনায় এই পরিমাণের অর্ধেক সরবরাহ করে। ডার্ক চকোলেটের একই পরিবেশনায় 10.8 গ্রাম স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে তবে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল ব্যাখ্যা করে যে ডার্ক চকোলেটের ফ্যাটগুলি কোকো মাখন থেকে আসে এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ায় না, মিল্ক চকোলেটের ফ্যাটগুলির তুলনায় যা মূলত দুধ-চর্বিযুক্ত।
চকোলেটটিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে চর্বিই নয়, উচ্চ চিনিযুক্ত উপাদান থেকেও ক্ষতি রয়েছে। প্রতি 1.55 আউন্স পরিবেশন করা বা প্রায় এক বারের মধ্যে 22.66 গ্রাম চিনি থাকে। যদিও অন্যান্য শর্করা হিসাবে চিনির শক্তি সরবরাহ করতে পারে, তবে এর বেশ কয়েকটি পুষ্টির ঘাটতি রয়েছে। চিনি দাঁতের ক্ষয়কে বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং চিনিতে উচ্চতর ডায়েট আপনার হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে। ডার্ক চকোলেটতে প্রচুর পরিমাণে চিনি থাকে তবে দুধের চকোলেট থেকেও কম থাকে। 70 শতাংশ ডার্ক চকোলেট পরিবেশন করে 1.55 আউন্স 10.54 গ্রাম চিনি সরবরাহ করে - দুধের চকোলেটের অর্ধেকেরও কম।